যমুনা লাইফে ব্যাপক অনিয়ম, গ্রাহকের দাবির টাকা পাওয়া অনিশ্চিত
ব্যাপক অনিয়মের তথ্য মিলেছে নতুন প্রজন্মের জীবন বিমা কোম্পানি যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। এতে নাজুক হয়ে পড়েছে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা। ভবিষ্যতে কোম্পানিটি বিমা গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে বলেও উঠে এসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তদন্তে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই তদন্ত করে আইডিআরএ। ‘মাত্রাতিরিক্ত কমিশন ও প্রশাসনিক ব্যয় এবং অন্যান্য অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ভবিষ্যতে গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে’ এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ জুলাই ১৩টি বিমা কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা তদন্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইডিআরএকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সম্প্রতি যমুনা লাইফের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে আইডিআরএ’র তদন্তদল। তদন্তে যমুনা লাইফের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চহার, দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন কম হওয়া, সম্পদ বিনিয়োগে অনিয়মসহ বেশকিছু অনিয়মের উঠে এসেছে।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, যমুনা লাইফ প্রতিবছর যে প্রিমিয়াম আয় করছে, তার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হচ্ছে ব্যবস্থাপনা খাতে। ফলে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির পাঁচ বছরের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করেছে তদন্ত কমিটি।
কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে মোট প্রিমিয়াম (নতুন ও নবায়ন মিলে) আয় হয় ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, বিপরীতে ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় হয় ১০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় ৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা, বিপরীতে ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় ৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।একইভাবে ২০১৯ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় ৯ কোটি ৭২ লাখ এবং ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় ৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০২০ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় ১০ কোটি ৯৬ লাখ এবং ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০২১ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় ১৪ কোটি ৯ লাখ এবং ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় ১৪ কোটি ৩ লাখ টাকা
এর মধ্যে আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে ২০১৭ সালে ২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ২ কোটি ৬৮ লাখ, ২০১৯ সালে ২ কোটি ৬৫ লাখ, ২০২০ সালে ৩ কোটি ২৮ লাখ এবং ২০২১ সালে ৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে ব্যবস্থাপনা খাতে যমুনা লাইফ অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
এভাবে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করায় কোম্পানিটির লাইফ ফান্ডে কোনো অর্থ নেই। ২০২১ সাল শেষে যমুনা লাইফের লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আগের বছর ২০২০ সালে লাইফ ফান্ড ছিল ঋণাত্মক ৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৯ সালে ঋণাত্মক ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ঋণাত্মক ৪ কোটি ৮১ লাখ এবং ২০১৭ সালে ঋণাত্মক ৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা লাইফ ফান্ড ছিল।
জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ডকে রক্তের সঙ্গে তুলনায় করা হয়। মানুষ রক্তশূন্য হয়ে পড়লে যেমন বাঁচে না, তেমনি একটি জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়লে ওই কোম্পানির পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে বিমা গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়া মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।
এ বিষয়ে একাধিক জীবন বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, লাইফ ফান্ড হলো জীবন বিমা কোম্পানির প্রাণ। লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক মানে ওই কোম্পানির কিছুই নেই। নিশ্চিতভাবে কোম্পানিটি সংকটের মধ্যে রয়েছে। এ ধরনের কোম্পানি থেকে গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা পাওয়া অনিশ্চিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত দ্রুত এ ধরনের কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
শুধু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় এবং ঋণাত্মক লাইফ ফান্ড নয়, কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয়েও বেহাল দশা। ২০২১ সালে কোম্পানিটির প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের দ্বিতীয় বর্ষ নবায়নের শতকরা হার মাত্র ১১ শতাংশ। ২০২০ সালেও দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের হার ছিল ১১ শতাংশ। তার আগে ২০১৯ সালে ২০ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ১৬ শতাংশ আদায় হয়। অর্থাৎ, প্রতিবছর কোম্পানিটি নতুন যে পলিসি বিক্রি করছে, পরের বছরেই তার সিংহভাগ আর আদায় হচ্ছে না।
তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চহার এবং দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন কম হওয়ায় বিমা আইন ২০১০ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রকৃত বিমা পলিসি ইস্যুর ক্ষেত্রে জোর দেওয়া, কমিশন ব্যয় হ্রাস করা, পলিসি তামাদি হওয়ার হার কমানো এবং কোম্পানির সম্পদ বিনিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী বিনিয়োগের নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কোম্পানির সার্বিক আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করারও সুপারিশ করেছে আইডিআরএ’র তদন্তদল।
যোগাযোগ করা হলে যমুনা লাইফের সিইও কামরুল হাসান খন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, আইডিআরএ’র তদন্তদল তদন্ত করে কী পেয়েছে তা আমার জানা নেই। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পাইনি।
এ সময় তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা অনিয়মগুলো তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়া, নবায়ন প্রিমিয়াম কম হওয়া এটা যমুনা লাইফের একার সমস্যা নয়। এসব সমস্যা গোটা সেক্টরের। আর সম্পদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা কোনো অনিয়ম করিনি। নিয়মের মধ্যে থেকেই বিনিয়োগ করা হয়েছে।
আইডিআরএ’র পরিচালক ও মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এখন আইন অনুযায়ী যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ধারাবাহিকভাবে কমছে যমুনা লাইফের স্থায়ী সম্পদ। ২০১৭ সালে জীবন বিমা কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদ ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এরপর ২০১৯ সালে ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, ২০২০ সালে ২ কোটি ১৯ লাখ এবং ২০২১ সালে ১ কোটি ৯২ লাখ টাকায় নেমে এসেছে।
যমুনা লাইফের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করে আইডিআরএ’র তদন্তদল অভিমত দিয়েছে, কোম্পানিটির আর্থিক ভিত্তি নাজুক পর্যায়ে। কোম্পানির নগদ আন্তঃপ্রবাহ কম থাকায় ভবিষ্যতে যমুনা লাইফ গ্রাহকদের উত্থাপিত বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হবে। সম্পদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়নি। আবার পাঁচ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়ে কোম্পানি অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করেছে।