লাইফ ফান্ড ১২৯ কোটি টাকা, গ্রাহকের পাওনা ১১৫ কোটি
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির লাইফ ফান্ড রয়েছে ১২৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। যার মধ্যে কোম্পানিটির বীমা গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে ১১৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। গ্রাহকের এই পাওনা প্রতিদিনই বাড়ছে।
অপরদিকে কমছে লাইফ ফান্ড। প্রিমিয়াম আয়, বিনিয়োগ আয় কমে যাওয়ায় লাইফ ফান্ডে যোগ হচ্ছে না নতুন কোন টাকা। ফলে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে প্রতিনিয়তই সক্ষমতা হারাচ্ছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
কোম্পানিটির ত্রৈমাসিক তথ্য পর্যালোচনা করে এই চিত্র উঠে এসেছে।
এদিকে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এমন আর্থিক দৈন্য পরিস্থিতির মধ্যে চলছে পরিচালকদের দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে কোম্পানিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও। ফলে কোম্পানিটির বীমা গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে অনিশ্চয়তা আরো গভীর হচ্ছে।
তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ৩৩ হাজার ২৯৭ গ্রাহকের বীমা দাবি অনিষ্পন্ন বা বকেয়া রয়েছে। এসব গ্রাহকের বকেয়া বীমা দাবির পরিমাণ ১১৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
কোম্পানিটিতে ৫৮০টি মৃত্যুদাবি বাবদ গ্রাহকদের পাওনা ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। মেয়াদ উত্তীর্ণ পলিসির সংখ্যা ৩১ হাজার ৩৩১টি, গ্রাহকদের পাওনা ১১০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ ছাড়াও সারেন্ডার, এসবি ও অন্যান্য ২ হাজার ৮৬টি বীমা দাবির বকেয়া ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে নতুন করে ৮ হাজার ৮৭৮টি বীমা দাবি উত্থাপন হয়েছে প্রগ্রেসিভ লাইফে, যার আর্থিক মূল্য ২৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
এদিকে অনিষ্পন্ন বীমা দাবির পরিমাণ বাড়লেও প্রতি বছরই কমছে প্রগ্রেসিভ লাইফের ‘লাইফ ফান্ড’। প্রিমিয়াম আয় ও বিনিয়োগ আয় কমে যাওয়ায় বাড়ছে না কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড। বর্তমানে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড আছে ১২৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
আইন অনুসারে মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা দাবি বকেয়া রাখার সুযোগ নেই। যেদিন মেয়াদ শেষ হয় সেদিনই দাবি পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ ১১৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করলে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড থাকে ১৪ কোটি ২১ লাখ টাকা।
সেক্ষেত্রে কোম্পানিটিতে যেসব নতুন দাবি উত্থাপন হবে তা পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসেই প্রগ্রেসিভ লাইফের লাইফ ফান্ড কমেছে ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা। অথচ আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটি বীমা দাবি পরিশোধ করেছে ১১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
অর্থাৎ শুধু বীমা দাবি পরিশোধ-ই নয়, লাইফ ফান্ড ভেঙে অন্যান্য খাতেও খরচ করছে কোম্পানিটি।
এর ফলে লাইফ বীমা কোম্পানির ‘প্রাণ’ হিসেবে পরিচিত ‘লাইফ ফান্ড’ কমে যাওয়ায় গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে প্রতিনিয়তই সক্ষমতা হারাচ্ছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
আবার ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দু’বছরের ব্যবধানে প্রগ্রেসিভ লাইফের প্রিমিয়াম আয় কমেছে ২০ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির গ্রস প্রিমিয়াম আয় ছিল ১১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যা ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে এসে দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
অপরদিকে একই সময়ে কোম্পানিটির বিনিয়োগ আয় কমেছে ১৮ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির বিনিয়োগ আয় ছিল ৫ কোটি ৬ লাখ টাকা, যা ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে এসে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
বর্তমানে কোম্পানিটির মোট সম্পদের পরিমাণ ২৭৮ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
পুঁজিবাজারে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে প্রগ্রেসিভ লাইফ, পর্ষদ পুনর্গঠন
বার্ষিক সাধারণ সভা করতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি ২০২০ সাল থেকে পরপর দু’বছর বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করতে না পারায় গত ১২ জুলাই প্রগ্রেসিভ লাইফকে ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
এ ছাড়াও বিএসইসি’র তদন্তে প্রগ্রেসিভ লাইফের বেশকিছু অনিয়মের তথ্য উঠে আসার প্রেক্ষিতে কোম্পানিটির পর্ষদ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। কোম্পানিটিকে ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরের ৪৫ দিনের মধ্যে নতুন পর্ষদ গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব:
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন প্রগ্রেসিভ লাইফের পরিচালকরা। সম্প্রতি এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। কোম্পানি পরিচালনায় উভয় পক্ষ তাদের নিজেদের পছন্দ মতো দু’জনকে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী ঘোষণা করেছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকেও এ সংক্রান্ত একাধিক চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
প্রগ্রেসিভ লাইফের পরিচালকদের এই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে কোম্পানিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও। গেল সপ্তাহে কেম্পানির প্রায় শ’ খানেক কর্মকর্তা-কর্মচারী পল্টন মডেল থাকায় গিয়ে কোম্পানি সচিব জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে কোম্পানি সচিব জহির উদ্দিনের অপসারণ চেয়ে লিখিত আবেদন করেন। আবেদনে অন্তত ৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাক্ষর করেন।
অপর দিকে জহির উদ্দিনও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অফিসের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পল্টন থানায় লিখিত আবেদন করেন।
এদিকে অফিসিয়াল কার্যক্রম বিঘ্ন ঘটায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়। গত ২৫ জুলাই কোম্পানিটির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী হিসেবে এই অফিস আদেশে স্বাক্ষর করেন জহির উদ্দিন।
কোম্পানির দাবি পরিশোধের সক্ষমতা ও আর্থিক অবস্থা নিয়ে জহির উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত কোম্পানিতে ভালো ব্যবসা হয়েছে। তবে পরবর্তীতে কোম্পানির মাঠে আর কোন লোকবল তৈরি হয়নি।
তিনি বলেন, কোম্পানিতে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এজেন্ট বা মাঠকর্মীদের একজনের কমিশন দেয়া হয়েছে অন্যজনকে। যারা ব্যবসা সংগ্রহ করেছে তারা কমিশন পাননি। ফলে মাঠকর্মীরা চলে গেছে।
তিনি আরো বলেন, ফান্ড সংকটে গ্রাহকদের মেয়াদোত্তর দাবি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। পুনর্ভরণ করার মতো ব্যবসার পরিবেশও নেই। গত মাসে প্রথম বর্ষ ব্যবসা হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ টাকা। তবে এক টাকাও ব্যাংকে জমা হয়নি। কারণ, ফিক্সড খরচ দিতে গিয়ে কোম্পানি থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।
তবে প্রগ্রেসিভ লাইফের এমন পরিস্থিতির জন্য তিনি কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে থাকা কথিত সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন। সিন্ডিকেটকে পরিচালনা পর্ষদের দু’একজন মদদ দেন বলে অভিযোগ করেন জহির উদ্দিন।
এ বিষয়ে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তা পরিচালক বজলুর রশিদের বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করে । তবে তিনি বাইরে আছেন উল্লেখ করে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।