সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ সাসপেন্ড, প্রশাসক নিয়োগ
সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কতিপয় পরিচালকের ১৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ ৬ মাসের জন্য সাসপেন্ড করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ।
প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এম ফেরদৌস, এনডিসি, পিএসসিকে।
প্রশাসক দায়িত্ব গ্রহণের পর যতদ্রুত সম্ভব কোম্পানিটিতে দেশি বা বিদেশি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে একটি পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা সম্পন্ন করবে। এ ছাড়াও বীমা পলিসি ইস্যুসহ কোম্পানির সকল কার্যক্রম পরিচালনা করবেন প্রশাসক।
আজ রোববার (২১ এপ্রিল) থেকেই প্রশাসক নিয়োগ কার্যকর করা হবে। গত ১৮ এপ্রিল আইডিআরএ’র পরিচালক (উপসচিব) আব্দুল মজিদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে এসব তথ্য জানা গেছে।
এর আগে গত ৪ এপ্রিল এক চিঠিতে সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ সাসপেন্ড করে কেন প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হবে না তার ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। ৫ কার্য দিবসের মধ্যে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। একইসঙ্গে ১৮ এপ্রিল কর্তৃপক্ষে আয়োজিত এ সংক্রান্ত শুনানিতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
এর আলোকে গত ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত শুনানিতে অংশ নেন সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। তবে এর আগের দিন ১৭ এপ্রিল কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের ৩ জন পরিচালক পদত্যাগ করেন। এরা হলেন- আহমেদ রাজিব সামদানী, হুদা আলী সেলিম ও হাজেরা হোসেন।
প্রশাসক নিয়োগ সংক্রান্ত আইডিআরএ’র চিঠিতে বলা হয়, গত ১৮ এপ্রিলের শুনানিতে কোম্পানির পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান নূর-এ হাফজা পৃথকভাবে জবাব দাখিল করেন। আর বোর্ডের পক্ষে জবাব দাখিল করেন কোম্পানিটির বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী মনিরুজ্জামান।
কাজী মনিরুজ্জামানের জবাবে বলা হয়, কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস নিজে ও তার পরিবারের অনুকূলে ইস্যুকৃত শেয়ারের মূল্য, মাসিক বেতন গ্রহণ, তার নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে অর্থ প্রদান, বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ব্যয় বাবদ অর্থ নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস দাবি করেন- সোনালী লাইফের কাছে তার পাওনা ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ ২৩ হাজার ৩০৫ টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত অফিস ভাড়া বাবদ ১১৫ কোটি ৭৬ লাখ ৫৮ হাজার ৮শ’ টাকা, অফিস ভাড়ার বিলম্ব ফি বাবদ পাওনা ২৩ কোটি ১৩ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৬ টাকা, কোম্পানিকে ঋণ দেয়া বাবদ পাওনা ১০ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার ৯৪২ টাকা তিনি গ্রহণ করেছেন।
তবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের এই দাবির সাথে কোম্পানির বুক অব একাউন্টস, লেজার সিস্টেম জেনারেটেট ভাউচার, ব্যাংকের এডভাইস চেক ইত্যাদি ডকুমেন্টসের সাথে কোন মিল না থাকায় তার এই বক্তব্য গ্রহণ করা হয়নি আইডিআরএ’র শুনানিতে। মূলত কোম্পানির টাকায় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিপুল ব্যয় বহন, নগদ গ্রহণ ও নিজ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি উদঘাটিত হওয়ার পর তা ভাড়া হিসেবে গ্রহণের দাবি করা হয়েছে।
মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের ভাড়ার টাকা সমন্বয় করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য না হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে- ২০১৩ সাল থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বছরভিত্তিক ফ্লোর এরিয়ার চাহিদা নির্ধারণ করে মোট ১৮৪ কোটি ৫২ লাখ ২২ হাজার ৮শ’ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে ২০১৩ সালে চুক্তি সম্পাদন করা হয়।
তবে ভাড়ার ওই চুক্তিতে কোম্পানির পক্ষে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বা চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেননি। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভবন মালিক মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের জামাতা ও সোনালী লাইফের স্পন্সর পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল। এ ধরণের চুক্তি স্বাক্ষরকে আইডিআরএ অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য ও অপকৌশল বলে মনে করছে।
অপরদিকে নূর-এ হাফজা তার জবাবে বলেন, তার নামে ইস্যুকৃত প্লেসমেন্ট শেয়ারের মূল্য তিনি পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন। এছাড়া তিনি কোম্পানি থেকে যে পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছেন তা পরিশোধ করতে ইচ্ছুক বলেও জানান।
আইডিআরএ বলছে, অসম্পূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ বা তথ্য গোপন, অস্বচ্ছ হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি, অভ্যন্তরীণ কন্ট্রোল সিস্টেমের অনুপস্থিতি, ক্যাশ চেকে বড় অংকের লেনদেন, এফডিআর জামানত রেখে বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ গ্রহণ এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ কোম্পানিটির ব্যাংক সিগনেটরির প্রায় সকলেই একই পরিবারের সদস্য।
এমন অবস্থায় সোনালী লাইফ কর্তৃপক্ষ বীমা কোম্পানিটির কার্যক্রম এমনভাবে পরিচালনা করছে যে, এতে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে কোম্পানি ও বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে।
এর আগে সোনালী লাইফের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করতে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর অডিট ফার্ম হুদাভাসী চৌধুরী এন্ড কোং-কে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওই তদন্তে ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ উঠে আসে।