সংকট কাটিয়ে উঠতে বেঙ্গল ইসলামী লাইফকে পরামর্শ
বীমা আইন লঙ্ঘন, উচ্চ হারে কমিশন প্রদান, নিয়ন্ত্রণহীন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, বিনিয়োগ থেকে আয় কম হওয়া, নাজুক লাইফ ফান্ড- এ ধরনের নানান কারণে সংকটে পড়ছে বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’র (আইডিআরএ) তদন্ত দলের পর্যবেক্ষণে এই জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানটির এমন ভয়বাহ চিত্র ফুটে উঠেছে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সকল সংকট কাটিয়ে উঠতে পরামর্শও দেয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।
আইডিআরএর তদন্ত রির্পোটে বলা হয়, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আইডিআরএর অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা লঙ্ঘন করছে বেঙ্গল ইসলামী লাইফ। ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানির মোট ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ ৮৪৪ মিলিয়ন টাকা, যার বিপরীতে অনুমোদিত সীমার পরিমাণ ৬৪৭ মিলিয়ন টাকা। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯৮ মিলিয়ন টাকা। অনুমোদিত সীমার উপর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার ৩০.৫৫% শতাংশ। কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম আয়ের ১০২ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ ব্যয় করেছে। কোম্পানির শুরু থেকে অর্থাৎ ২০১৩ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ ৮২৭ মিলিয়ন টাকা যার বিপরীতে মোট ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ ৮৪৪ মিলিয়ন টাকা। কোম্পানিটি প্রিমিয়াম আয় হতে ১৭ মিলিয়ন টাকা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ ব্যয় করেছে, যা কোম্পানির আর্থিক অবস্থাকে নাজুক করেছে- তদন্ত দলের পর্যবেক্ষণে এমন তথ্য বেড়িয়ে এসেছে।
বেঙ্গল ইসলামী লাইফের সম্পদ, বিনিয়োগ ও লাইফ ফান্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে আইডিআরএর পর্যবেক্ষণে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘কোম্পানির প্রিমিয়াম আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ায় কোম্পানিতে সম্পদ গঠিত হয়নি। ২০১৩ হতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোম্পানির লাইফ ফান্ড নেগেটিভ ছিল, সুতরাং কোম্পানিতে বিনিয়োগ বাবদ যা অর্জিত হয়েছে তা মূলত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বিনিয়োগ বাবদ অর্জিত অর্থ। ২০১৩ সাল শেষে কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২০০ মিলিয়ন টাকা ২০২১ সাল শেষে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫১ মিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে কোম্পানির উদ্যোক্তাগণ কর্তৃক প্রদত্ত ১৮০ মিলিয়ন টাকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’’ কোম্পানির এরকম নাজুক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ থেকে আয়ের হার কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে না বলেও মত দিয়েছে তদন্ত কমিটি।
বেঙ্গল লাইফে বাড়ছে তামাদি পলিসির হার। কোম্পানীর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সাল শেষে কোম্পানির ইস্যুকৃত পলিসির সংখ্যা মাত্র টি ৯৬৩ টি যেগুলোর মধ্যে ৯৩৫ টি পলিসি ২০১৪ সালে তামাদি হয়ে যায়। কোম্পানিতে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পলিসি তামাদি হয়ে যায়। ২০১৯ সাল মোট চলমান পলিসির সংখ্য ৩৯২৬ টি যার মধ্যে ২০২০ সালে ৩৬২৩টি পলিসি তামাদি হয়ে যায়। এতো সংখ্যক তামাদি পলিসি কোম্পানীর প্রিমিয়াম আয় নিয়েও ঝুঁকির মুখে রয়েছে বেঙ্গল লাইফ।
একইসঙ্গে, কোম্পানির পলিসি ব্যবস্থাপনা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। দায় পরিশোধের সক্ষমতা নিয়েও সন্দিহান আইডিআরএ। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অভিমত হচ্ছে, ২০২৪ সালে ১৯৬৭টি পলিসির বিপরীতে ৬১.১৫ মিলিয়ন এবং ২০২৫ সালে ৩২২৪টি পলিসির বিপরীতে ১১৫.৭৯ মিলিয়ন টাকার এবং ২০২৬ সালে ৪৫৪১টি পলিসির বিপরীতে ২২৪.৫৯ মিলিয়ন টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে। এছাড়াও, মেয়াদউত্তীর্ণ বীমা দাবি পরিশোধের সময় আর্থিক ঝুঁকির মুখে পড়বে এই জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানটি- এমন শঙ্কা প্রকাশ করছে আইডিআরএ। তাদের মতে, ২০১৫ সাল থেকে বেঙ্গল লাইফ মৃত্যু দাবি পরিশোধ করছে। কোম্পানিটির এই মৃত্যু দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে- পুনঃবীমা সুবিধা চালু থাকায় কোন আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয় নি। তবে জীবন বীমার ক্ষেত্রে, সাধারণ ১০ বছর পর মেয়াদী বীমা পলিসিগুলোর বীমা দাবি পরিশোধ শুরু হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা শুরুর বছরগুলোতে কোন মেয়াদউত্তীর্ণ বীমা দাবি ছিল না। সেক্ষেত্রে মেয়াদউত্তীর্ণ বীমা দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে আর্থিক সংকটে পড়তে পড়বে প্রতিষ্ঠান।
আইডিআরএর তদন্ত রির্পোটে বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের অভিযোগের বিবরণ, কোম্পানির বক্তব্য এবং প্রাপ্ত তথ্য, প্রমাণিক পর্যালোচনায় বেশ কিছু ফলাফল উঠে এসেছে :
১। কোম্পানির গঠনকাল ২০১৩ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানির মোট ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ ৮৪৪ মিলিয়ন টাকা যার বিপরীতে অনুমোদিত সীমার পরিমাণ ৬৪৭ মিলিয়ন টাকা এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ ১৯৮ মিলিয়ন টাকা। অনুমোদিত সীমার উপর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার ৩০.৫৫% শতাংশ। কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম আয়ের ১০২ শতাংশই ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ ব্যয় করেছে।
২। ২০১৩ হতে ২০২১ সালের মোট ৯ বছরের তথ্য অনুযায়ী মোট প্রিমিয়াম আয় ৮২৭.৬ মিলিয়ন টাকা যার বিপরীতে ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৮৪৪ মিলিয়ন টাকা এক্ষেত্রে কোম্পানির প্রকৃত ব্যবস্থাপনা ব্যয় মোট প্রিমিয়াম আয়ের ১০২%।
৩। ২০২১ সালে কোম্পানি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের উপর ৯৫% পর্যন্ত কমিশন প্রদান করেছে যা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত কমিশন সীমার দ্বিগুন। উচ্চ হারে কমিশন প্রদানের ফলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধি পাচেছ।
৪। কোম্পানির বর্তমান লাইফ ফান্ড মাত্র ৩৫ মিলিয়ন টাকা এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের উচ্চ হারের কারণে প্রিমিয়াম আয়ের সামান্য অংশ লাইফ ফান্ডের সাথে যোগ হওয়ায় উল্লেখযোগ্যভাবে লাইফ ফান্ড বৃদ্ধির সুযোগ নেই। কিন্তু কোম্পানিকে ২০২৩ হতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট ৪১৯ মিলিয়ন টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে কোম্পানি বীমা দাবি পরিশোধ করতে সক্ষম হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে বীমা দাবি পরিশোধে কোম্পানিকে আর্থিক সংকটে পড়তে হবে বলেও মত দিয়েছে আইডিআরএ।
উল্লেখ্য, বীমা আইন লঙ্ঘন, নানা অনিয়ম, গ্রাহকদের আমানত লোপাট এবং বিমা দাবী পরিশোধে অনীহার কারণে এমনিতেই আস্থা সংকটে বিমা খাত। বীমা খাতের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির পরিবর্তে সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে। এ অবস্থায় গ্রাহকের পলিসির টাকা বেপরোয়া ব্যয়সহ বীমা কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়ম রোধে কঠোর অবস্থানে আইডিআরএ। যার ধারাবাহিকতায় ১৩ টি জীবন বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়, ব্যবসায়িক পরিস্থিতি, আর্থিক অবস্থা, গ্রাহককে দেয়া কমিশন, গ্রাহককে পরিশোধ করা দাবি, সম্পদের পরিমাণ, বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ বিতরণ এবং প্রশাসনিক ব্যয় খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ সময় বেঙ্গল লাইফে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে ‘বীমা দাবি পরিশোধে কোম্পানিকে আর্থিক সংকটে পড়তে হবে’ বলে মত দেয় আইডিআরএ।
‘তদন্ত রির্পোটে আইডিআরএ তেমন কোন সমস্যা খুঁজে পায় নি’ এমন দাবী করে বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও এম এম মনিরুল আলম বলেন, এটা অনেক পুরোনো ইস্যু। এখন আমরা মেয়াদউত্তীর্ণ বীমা দাবি পরিশোধ করছি। আইডিআরএ তামাদি পলিসির হার কমানোর পাশাপাশি রিনিউয়াল প্রিমিয়াম আদায়ের ক্ষেত্রে জোর দিতে পরামর্শ দিয়েছেন, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি।