কামরুল হাসান এবার বিএসএস-এমবিএ পাস!
1 min read

কামরুল হাসান এবার বিএসএস-এমবিএ পাস!

যমুনা লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কামরুল হাসানের নিয়োগ অনুমোদন নবায়নের আবেদন করেছেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান বদরুল আলম খান। এবারের আবেদনে কামরুল হাসানের নতুন শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএসএস ও এমবিএ পাস। এর মধ্যে বিএসএস পাস করেন ২০১৯ সালে ও এমবিএ করেন ২০২১ সালে। তার এই দুটি সনদই অবৈধ ঘোষিত ইবাইস ইউনিভার্সিটির।

এর আগে ২০২০ সালে প্রথমবার নিয়োগ অনুমোদনের আবেদনের সময় কামরুল হাসান ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের ডিমড ইউনিভার্সিটি থেকে দূরশিক্ষণে এমবিএ পাস। তার নিয়োগ অনুমোদন দেয়া হয় ২০২২ সালে। তার এই নিয়োগ অনুমোদন প্রক্রিয়ার ১ বছরের মধ্যে তিনি ইবাইস ইউনিভার্ষিটির কোন সনদ দাখিল করেননি। 

ফলে কামরুল হাসানের নতুন করে দাখিল করা অবৈধ ঘোষিত ইবাইস ইউনিভার্সিটির বিএসএস ও এমবিএ পাসের সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

যদিও কোম্পানিটির চেয়ারম্যান বদরুল আলম নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানিয়েছেন, ইবাইস ইউনিভার্সিটির বিএসএস পাস ও এমবিএ পাসের সনদ তিনি যাচাই করে সঠিক পেয়েছেন। সনদ ২টির সঠিকতা তিনি যাচাই করেন ইবাইস ইউনিভার্সিটি থেকে।

অথচ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) থেকে কামরুল হাসানের সনদ যাচাই করে তারা প্রত্যায়ন পত্র দাখিল করতে।

তথ্য অনুসারে, কামরুল হাসানের নিয়োগ নবায়নের আবেদন করা হয় ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর। নিয়োগ নবায়নের এই আবেদনে কামরুল হাসানের শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করা হয় ভারতের ডিমড ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০২ সালে এমবিএ পাস।

এই আবেদনে ইবাইস ইউনিভার্সিটি থেকে কামরুল হাসানের অর্জন করা ২০১৯ সালের বিএসএস (অর্থনীতি) এবং ২০২১ সালের এমবিএ (মার্কেটিং) ডিগ্রির সনদ দাখিল করা হয়নি। এমনকি এ সংক্রান্ত কোন তথ্যও উল্লেখ করা হয়নি। ইবাইস ইউনিভার্সিটির সনদ ২টি নিয়োগ নবায়নের আবেদনে সংযুক্ত করা হয় ৬ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে।

অপরদিকে কামরুল হাসানের দাখিলকৃত ইবাইস ইউনিভার্সিটির সনদপত্র দু’টির বৈধতার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)’র প্রত্যায়নপত্র চেয়ে গত ২৫ ডিসেম্বর যমুনা লাইফের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

এই প্রেক্ষিতে গত ২ জানুয়ারি আইডিআরএ’কে পাঠানো চিঠিতে যমুনা লাইফের চেয়ারম্যান জানান, কামরুল হাসান খন্দকারের ইবাইস ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসএস (অর্থনীতি) ও এমএ (মার্কেটিং) ডিগ্রির সনদপত্রের সঠিকতা যাচাই হয়েছে।

অর্থাৎ কামরুল হাসানের সনদ দু’টির বিষয়ে ইউজিসি’র প্রত্যায়নপত্র দেখাতে পারেনি যমুনা লাইফ।

যে কারণে বৈধতা নেই ইবাইস ইউনিভার্সিটির সনদের

২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর দেশের ১৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সনদ অবৈধ ঘোষণা করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) । ওই ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি ছিল ইবাইস ইউনিভার্সিটি। ২০১২ সালের পর থেকে ইবাইস ইউনিভার্সিটির সনদের কোন বৈধতা নেই।

ইউজিসি’র গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অর্জিত ডিগ্রির মূল সনদ ভাইস চ্যান্সেলর এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক স্বাক্ষরিত হতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির নিয়োগকৃত উপাচার্যের স্বাক্ষর ছাড়া সার্টিফিকেট গ্রহণযোগ্য হবে না এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসি কর্তৃক স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট অবৈধ হবে।

জানা যায়, ইবাইস ইউনিভার্সিটিতে সর্বশেষ নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর খন্দকার রেজাউর রহমান। ২০১০ সালে তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন। ২০১২ সালে মারা যান খন্দকার রেজাউর রহমান। এ কারণে ২০১২ সালের পর থেকে ইবাইস ইউনিভার্সিটির কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ধারা ১৭ ও ১৯ অনুযায়ী বৈধ সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল না থাকায় ইবাইস ইউনিভার্সিটির একাডেমিক, প্রশাসনিক, আর্থিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, পরীক্ষা ও ফলাফল এবং প্রদত্ত একাডেমিক সনদের আইনগত কোনো বৈধতা নেই।

ফলে ইবাইস ইউনিভার্সিটি থেকে নেয়া কামরুল হাসানের ২০১৯ সালের বিএসএস ও ২০২১ সালের এমবিএ সনদেরও কোন বৈধতা নেই।

যেভাবে এর আগে কামরুল হাসান অনুমোদন পান

কামরুল হাসান যমুনা লাইফে চীফ মার্কেটিং অফিসার যোগদান করেন ২ মার্চ ২০২০ সালে। এর এক মাস পরেই ৮ অক্টোবর ২০২০ সালে তাকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় যমুনা লাইফ। এই নিয়োগ অনুমোদনের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয় ২ ডিসেম্বর ২০২০ সালে।

এ সময়ে প্রশ্ন উঠেছিল মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ অনুমোদনের জন্য কামরুল হাসানের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতা নেই। এ প্রশ্ন উঠেছিল মুখ্য নির্বাহী পদে কামরুল হাসানের নিয়োগ অনুমোদনের জন্য দাখিল করা শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার সনদের তথ্য অনুসারে।

এরপরও কামরুল হাসানকে ২০২০ সালে ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ বছরের জন্য তার নিয়োগ অনুমোদন করা হয়। এই অনুমোদন দেয়া হয় ২১ মার্চ ২০২২সালে।

যেভাবে অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ হয় কামরুল হাসানের

কামরুল হাসান যমুনা লাইফের মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ অনুমোদনের জন্য আবেদনের আগে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ৯ মাস ২২ দিন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চাকরি করেন। এ সময়ে তিনি মুখ্য নির্বাহীর চলতি দায়িত্বেও ছিলেন।  যমুনা লাইফের চীফ মার্কেটিং অফিসার (সিএমও) পদে চাকরি করেন ৭ মাস ২৫ দিন। এছাড়া সানফ্লাওয়ার লাইফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চাকরি করেন ১ বছর ১১ মাস ১৬ দিন।

কোম্পানিগুলোর অর্গানোগ্রাম অনুসারে এসব পদের কোনটিই মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদ নয়।

ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডির অনুসন্ধানে দেখা যায়, কামরুল হাসানের মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা আছে কি না তা যাচাই করতে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মতামত জানাতে চিঠি দেয় আইডিআরএ।

সানফ্লাওয়ার লাইফকে চিঠি দেয়া হয় ২৭ জানুয়ারি ২০২১ সালে। এর উত্তরে সানফ্লাওয়ার লাইফ ৩১ জানুয়ারি ২০২১ সালে আইডিআরএ’কে জানায়, কামরুল হাসান ২০১৮ সালের ১১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত ১ বছর ৭ মাস ২০ দিন চাকরি করেন। চিঠিতে আরো বলা হয়, “কোম্পানির অর্গানোগ্রাম অনুসারে মুখ্য নির্বাহীর পরবর্তী পদ হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যবস্থপনা পরিচালক। তার পরবর্তী পদ হচ্ছে ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক।”

ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, “কামরুল হাসানের কর্মকালীন সময়ে কোম্পনিতে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি শূন্য ছিল। উক্ত সময়ে কোম্পানিতে আরো ২ জন ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর কর্মরত ছিলেন। ”

অর্থাৎ কামরুল হাসানের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদ নয়, তা জানিয়ে দেয় সানফ্লাওয়ার লাইফ।

অথচ সানফ্লাওয়ার লাইফে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদটি শুন্য থাকায় কামরুল হাসানের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদটি মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদ বলে বিবেচনাযোগ্য বলে দাবি করেন যমুনা লাইফের চেয়ারম্যান বদরুল আলম। ১৬ আগস্ট আইডিআরএ’কে লেখা এক চিঠিতে তিনি এ দাবি করেন। তার এ দাবি মেনে নেয় আইডিআরএ।

আবার যমুনা লাইফেও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ শূন্য থাকায় চীপ মার্কেটিং অফিসারের পদকেও মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদ হিসেবে ধরে নেয় আইডিআরএ।  ফলে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদে ৩ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ হয়ে যায় কামরুলের।

আবার কামরুল হাসান ২০০২ সালে ভারতের ডিমড ইউনিভার্সিটি অব লক্ষ্মৌ থেকে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করেন। এই ইউনিভার্সিটি ভারতীয় শিক্ষা পরিষদের (উত্তর প্রদেশ) অধীন অনুমোদন প্রাপ্ত।

২ বছর মেয়াদী এই এমবিএ কোর্সের মেয়াদকাল, এমবিএ এই ডিগ্রির প্রাপ্ত গ্রেড, বাংলাদেশের সাথে সমমান বা সমতাকরণে ইউজিসি’র প্রত্যয়নপত্র দাখিল করতে বলা হয় কামরুলকে।

এই চিঠির প্রেক্ষিতে ইউজিসির কোন প্রত্যয়নপত্র দাখিল না করে কামরুল আইডিআরএ’কে লিখিতভাবে জানায়, ইউজিসি থেকে তাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, বিদেশে স্বশরীরে অবস্থান করে ডিগ্রি অর্জন করলে ইউজিসি অর্জিত সেই ডিগ্রির সমতাকরণের প্রত্যায়নপত্র দেয়। কিন্তু দূর শিক্ষন পদ্ধতিতে অর্জিত ডিগ্রির সমতকারণ প্রত্যায়ন ইউজিসি করে না।

আইডিআরএ কামরুলে এই বক্তব্যকেও বিবেচনায় নেয়। আইডিআরএ’র সাবেক  চেয়ারম্যান ড. এম মোশারফ হোসেন মতামত দেন,  বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহু পূর্বে অর্থাৎ প্রবিধানমালা হওয়ার পূর্বে এমবিএ অর্জন করায় কর্তৃপক্ষের সভায় অনুমসর্থনের শর্তে অনুমোদন করা যায়।” তিনি আরো মতামত দেন, উল্লেখ্য দির্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত থাকাও আইনের লঙ্ঘন এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য কল্যানকর নয়।”

এমন মতামতের পর কামরুলের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্তও পূরণ হয়ে যায়।  কামরুল হাসানের ডিমড ইউনিভার্সিটির এমবিএ পাসকে ২ বছর মেয়াদি ধরা হয়।

যদিও কামরুল হাসানের এক্সিকিউটিভ এমবিএ সনদের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)’র রিসার্চ সাপোর্ট এন্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক জানান, বিদেশি ডিগ্রির ক্ষেত্রে সমতা বিধান না করে সে বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদৌ সেখানে পড়ালেখা করেছেন কিনা সেটা আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া ওই বিদেশি ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য কিনা এবং গ্রহণযোগ্য হলেও সেটার মান কি হবে তা সমতা বিধান না করে বলা সম্ভব নয়।

কামরুল হাসান খন্দকারের বিদেশি ডিগ্রির বিষয়ে ইউজিসি’র রিসার্চ সাপোর্ট এন্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের উপ-পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান জানিয়েছিলেন, আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এটি এক বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *